সিলেটি ভাষার আদ্যোপান্ত

0
4278

লিখেছেন ইনামুল হাফিজ লতিফী,

 

এক

সিলেটি ভাষা এখনকার সময়ে আমাদের কাছে পরিচিত বাংলা ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ হিসেবে (১)। কিন্তু সবসময় কি বিষয়টা একইরকম ছিল? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাবার জন্য ঘুরে আসতে হবে সিলেটি ভাষার ইতিহাসের প্রাঙ্গন থেকে।

সিলেটি ভাষার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এ ভাষার প্রচলন শুধু সিলেট অঞ্চলেই সীমায়িত নয় বরং ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা সিলেটি। এখানে বলে রাখা ভাল, যদিও মৌখিকভাবে সিলেটি ভাষা (ছিলটি) খুবই প্রাচীন তবে ভাষা গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর মতানুযায়ী জটিল এবং সংস্কৃত প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে ‘সিলেটি নাগরি’ লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে (১)।

 

‘সিলেটি নাগরি’ লিপি এবং পাশাপাশি নাগরি অক্ষরগুলোর সংশ্লিষ্ট বাংলা অক্ষরগুলোও এখানে দেয়া হলো,

ছিলটি নাগরি এবং বাংলা লিপি

 

দুই

সিলেটি নাগরি লিপি ব্যাবহার করে লিখা কয়েকটি বইয়ের স্ক্রিনশট দেয়া হলো সিলেটি রিসার্চ সেন্টার এন্ড ট্র্যান্সলেশন সেন্টারের ওয়েবসাইট (৯) থেকে,

 

 

 

 

 

তিন

উইকিপিডিয়ার ইংরেজি ভার্সন অনুযায়ী,

“Sylheti (Sylheti: ছিলটী/ Bengali: সিলেটী) is an Indo-European language, primarily spoken in the Sylhet region of north east Bangladesh and Barak Valley region of south Assam” (২)।

এবং এই সিলেটি ভাষা এর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলা ভাষা থেকে অনেকটাই আলাদা, যা একটি গবেষণা প্রবন্ধে উঠে এসেছে,

“Sylheti language differs markedly from standard Bengali.”, (৬)।

অর্থ্যাৎ সিলেটি ভাষা ইন্দো- ইউরোপিয়ান ভাষা গোত্রের অন্তর্গত একটি ভাষা যা প্রধানত বাংলাদেশের উত্তর- পূর্বে অবস্থিত সিলেট এবং দক্ষিণ আসামের বরাক ভ্যালি অঞ্চলের ভাষা (১)। যদিও ভাষাটির উদ্ভব এ অঞ্চলেই তবে সিলেটি ভাষায় এখন প্রায় ১০.৭ মিলিয়ন অর্থ্যাৎ ১ কোটি ৭০ লাখ (৩) মানুষ কথা বলে থাকে, যারা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। অন্যদিকে লন্ডনের সিলেটি রিসার্চ সেন্টার এন্ড ট্র্যান্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলসহ সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের মাতৃভাষা হচ্ছে সিলেটি (১)।

 

তবে আন্তর্জাতিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য হলো, ন্যাশনালেনসাইক্লোপেডিন (Swedish language encyclopedia) কর্তৃক পৃথিবীর ১০০ টি সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃত ভাষার উপর গবেষণা করে প্রকাশিত বই “Världens 100 största språk 2007 (The World’s 100 Largest Languages in 2007)” উল্লেখিত সংখ্যাটি। বইটিতে সিলেটি ভাষা ব্যাবহারকারীর সংখ্যা বলা হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ এবং সেটা সেই ২০০৭ সালে (৪)। স্বাভবিকভাবেই ২০১৩ সালে এসে এই ভাষার ব্যাবহারকারী বেড়েছে, যেহেতু সিলেট বিভাগের জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতকরা হার ২.১ (৫)।

 

এবারে এই সিলেটি নাগরি অর্থ্যাৎ সিলেটি ভাষার একসময়কার নিজস্ব লেখ্য রূপের দিকে তাকানো যাক। “Cepstral & Mel-Cepstral Frequency Measure of Sylheti phonemes” শীর্ষক একটি প্রবন্ধে উল্লেখ পাওয়া যায়,

“Sylheti language is written in the Sylheti Nagri script which has 5 independent vowels, 5 dependent vowels attached to a consonant letter and 27 consonants. Sylheti is quite different from standard Bengali, in its sound system, the way in which its words are formed and in its vocabulary.”

(৭)

উপরের এ অংশ থেকে জানা যাচ্ছে, সিলেটি ভাষা লিখা হয় সিলেটি নাগরি লিপি দিয়ে, যার ৫ টি স্বাধীন স্বরবর্ণ আছে, ৫ টি অধীন স্বরবর্ণ রয়েছে যা একটি ব্যাঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত এবং এছাড়াও নাগরি লিপি ২৭ টি ব্যাঞ্জনবর্ণ ধারণ করে।

 

চার

একই গবেষনা প্রবন্ধ থেকে আরও জানা যায়,

“Unfortunately, due to lack of proper attention given to this language and increasing popularity of the Bengali and Assamese language among the common mass, which might be due to socioeconomic and political reasons, this century old language is gradually dying out. But it has to be admitted that once it the only link language between Assam, Bangladesh and Bengal.”

(৭)

ঊদ্ধৃতিটি ভাবানুবাদ করলে এই দাঁড়ায় যে, দূর্ভাগ্যবশত সিলেটি ভাষার প্রতি সঠিক মনোযোগের অভাবে এবং সাধারণ মানুষের মাঝে বাংলা ও অস্‌মি ভাষার বাড়ন্ত জনপ্রিয়তার প্রভাবে, এই শতাব্দী প্রাচীন এই ভাষাটি ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে, যা সত্যিকার অর্থে হয়ে থাকতে পারে আর্থ- সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু, এটা মেনে নিতে হবে যে একসময় এই ভাষাটাই ছিল আসাম, বাংলাদেশ, আর বাঙ্গালি এর মাঝে সংযোগস্থাপনকারী একটা ভাষা। অর্থ্যাৎ, এ থেকেই সিলেটি ভাষার ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হওয়ার ২ টি প্রধান কারণ পাওয়া যায় যার মধ্যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অন্যতম।

 

উইকিপিডিয়া থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য নিয়ে আরও ভালভাবে বুঝা যায় যে পাকিস্তানের যুদ্ধের রাজনীতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ মনোভাব কিভাবে এ ভাষাটিকে ধীরে ধীরে শেষ করে দেয়। যাই হোক উইকিপিডিয়া (২) থেকে জানা যায়,  ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মৌলভি আব্দুল করিম নামের একজন অনেক বছর ইউরোপে থেকে প্রিন্ট করা শিখে নেন। এরপর তিনি সিলেটে এসে কাঠের ব্লক তৈরি করেন ‘সিলেটি নাগরি’ এর জন্য, আর সেগুলো তিনি প্রিন্টিং কাজে ব্যাবহার করা শুরু করেন ১৮৭০ সালের দিকে তার উদ্যোগে সিলেটে শহরে অবস্থিত ইসলামিয়া প্রেসে। প্রায় একই সময়ে এধরনের সিলেটি ভাষায় প্রিন্ট নেয়া যায় এমন সব প্রেস্‌গুলো গড়ে উঠতে থাকে সুনামগঞ্জ, শিলং এবং কলকাতায়। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেই প্রেস্‌গুলো ১৯৭০ সালের দিকে বন্ধ হতে শুরু করে, যেহেতু সিলেটি নাগরি এই সময়টার দিকে ব্যাবহৃত হতো শুধুমাত্র ভাষাবিদদের এবং শিক্ষাবিদদের দ্বারা।

 

আর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সবকটি সিলেটি নাগরি প্রেস্‌ ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে সিলেটি ভাষার স্বকীয় লেখ্য রূপ একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায় এবং পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষাকে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের একমাত্র ভাষা হিসেবে নির্বাচন করে এবং সিলেটি ভাষাকে একটি ‘নব্য ভাষা’ হিসেবে বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অফুরান চেষ্টাকে সে সময় বাংলাদেশে সরকারের সমমনা রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তিগুলো জোটবদ্ধভাবে মোকাবেলা করে (২)।

 

আর তাই, সিলেটি ভাষা সেই সময়েই তার ঐতিহ্য হারিয়ে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ে। অথচ সিলেটি ভাষার লেখ্য রূপ যদি এখনো থাকতো, সিলেটি ভাষায়- সিলেটি নাগরি লিপি অনুযায়ী যদি বই ছাপা হতো, তাহলে আজ এই ভাষাটি অত্যন্ত শক্তিশালী একটা পর্যায়ে থাকতো। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে আদিবাসীদের জন্য সিমীত আকারে হলেও তাদের নিজস্ব ভাষায় বই ছাপা হয়, কিন্তু গড়ে বাংলাদেশের (১৬ কোটি জনসংখ্যা, (৮)) প্রতি ১৬ টি মানুষের ১ জন সিলেটি (১ কোটি সিলেটি, (১)) হলেও অর্থ্যাৎ, সিলেটিরা বাংলাদেশের প্রায় একটি বৃহৎ অংশ হলেও সিলেটি ভাষায় সরকারের পক্ষ থেকে একটিও বই ছাপা হয় না। ইচ্ছে করেই এই ঐতিহ্যবাহী ভাষাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে যেনো সব দলের সরকারই বদ্ধপরিকর।

 

তথ্যসূত্রঃ

১) উইকিপিডিয়া_সিলেটি ভাষা

২) http://en.wikipedia.org/wiki/Sylheti_language

৩) http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_languages_by_number_of_native_speakers

৪) “Världens 100 största språk 2007” The World’s 100 Largest Languages in 2007, Nationalencyklopedin

৫) BBS

৬) Ludden D. (29th November, 2003), Investing in Nature around Sylhet , EPW Special Articles, Economic and Political Weekly.

৭) Suchismita Sinha, Jyotismita Talukdar, Purnendu Bikash Acharjee, P.H.Talukdar (November – December 2012), Cepstral & Mel-Cepstral Frequency Measure of Sylheti phonemes, Volume 1, No.3, International Journal of Computing, Communications and Networking, WARSE.

৮) https://www.cia.gov/library/publications/the-world-factbook/geos/bg.html

৯) www.sylheti.org.uk

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here