করোনাভাইরাসের মাঝে যথাযথ সুরক্ষার অভাবেও পুলিশ দমেনি, বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত

0
668
গভীর রাতে নিজেদের রান্না করা খাবার অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করছেন ফরিদপুর জেলা পুলিশের সদস্যারা

করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংকটময় পরিস্থিতিতে এক ভিন্নরকম মানবিক পুলিশ বাহিনীকে দেখছে বাংলাদেশ। পুলিশকে দেখে এখন মানুষ আর দৌঁড়ে পালায় না, বরং পুলিশ দেখে ছুটে আসে অনাহারীর হাত।

 

করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি উপেক্ষা করেই গভীর রাতে ঘরে ঘরে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছানো থেকে শুরু করে অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানো, এমনকি মৃত ব্যক্তির দাফনেও পুলিশকে দেখা যাচ্ছে।

এর ফলে পক্ষান্তরে দামও দিতে হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকেই। এখন পর্যন্ত একক পেশাজীবী হিসেবে পুলিশেই সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন ৭ জন সদস্য। এর পরেও নিজের নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি যেকোনো প্রয়োজনে সবার আগে মানুষের পাশে দাড়াচ্ছেন পুলিশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেশাগত কারণেই পুলিশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যাপক মেলামেশার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়া, সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব রয়েছে বা সুরক্ষা সামগ্রী পেতে পুলিশ অপেক্ষা করছে, এমন কখনো হয়নি। এর ফলে সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পুলিশের এত বেশি সংখ্যক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

 

রোববার (১০ মে ২০২০) পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাসে পুলিশের এক হাজার ৫০৯ জন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মেট্রোপলিটনের (ডিএমপি) সদস্যই রয়েছেন ৭৪৫ জন।

পুলিশের এত বেশি সংখ্যক সদস্য আক্রান্তের বিষয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশন নিশ্চিত করতে পুলিশকে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে হয়েছে। পাশাপাশি কোনো রোগীর চিকিৎসা প্রয়োজন হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিতেও পুলিশ এগিয়ে আসছেন।

এর বাইরে করোনা পরিস্থিতির সুযোগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে বা কালোবাজারি-মজুদ নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে যেতে হয়েছে। খুব কাছে থেকে মানুষের সঙ্গে কাজ করে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হয়েছে।

যখন কোনো অনুষ্ঠানের অযুহাতে বা উপলক্ষে বেশি মানুষের সমাগম হচ্ছে, যখন গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন তখন পুলিশকেই স্বশরীরে সেই সমাবেশের মাঝখানে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।

 

এই সময়ে পুলিশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল ত্রাণ বিতরণ। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ বিতরণ কাজে সহায়তা করছে পুলিশ। এছাড়া, মানুষের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্থানে বাড়ি-বাড়ি নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় গোপণ রেখে রাতের আঁধারে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দিতে কাজ করছে বাহিনীটি।

করোনায় বা সন্দেহভাজন করোনায় কেউ মারা গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাশে কাউকে পাওয়া যাচ্ছেনা। অনেক সময় মৃত ব্যক্তিদের দাফনেও স্থানীয়দের বাধা দিতে দেখা গেছে। তখন পুলিশ সদস্যরাই ওই মৃত ব্যক্তির সৎকার বা জানাযার-দাফনে এগিয়ে যাচ্ছেন।

 

একই রকমভাবে পুলিশের প্রধান কাজ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যখন কোনো আসামি গ্রেফতার করতে যাচ্ছেন, তখন স্পর্শ না করে আসামিকে গ্রেফতার সম্ভব হচ্ছেনা। আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে অবশ্যই মানুষের খুব কাছে যেতে হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্টদের মতে, পুলিশ সদস্যদের যারা ব্যারাকে বা পুলিশ লাইনসে বসবাস করেন, সেখানকার ব্যবস্থাপনাও বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ। একটি কক্ষের মধ্যেই অনেকে বসবাস করেন। সেখানে যখন কোনো একজন সদস্য আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন, তার মাধ্যমে সহযেই অন্য সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এরপরও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রথম দিক থেকেই জনসচেতনা বৃদ্ধি করা নিয়েও কাজ করছে বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পুলিশের ৭ জন সদস্য করোনা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করেছেন। তারা হলেন- ডিএমপির কনস্টেবল জালাল উদ্দিন খোকা (৪৭), এএসআই শ্রী রঘুনাথ রায় (৪৮), কনস্টেবল জসিম উদ্দিন (৪০), এএসআই মো. আব্দুল খালেক (৩৬), কনস্টেবল মো. আশেক মাহমুদ (৪৩), এসআই সুলতানুল আরেফিন এবং এসবির এসআই নাজির উদ্দীন (৫৫)। রোববার (১০ মে) পর্যন্ত ১৪৭ জন করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্য সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

এদিকে, পুলিশের মহাপরিদরবশক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। আইজিপির নির্দেশে অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের দেখাশোনার জন্য গঠন করা হয়েছে ‘বিশেষ টিম’। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল ছাড়াও রাজধানী এবং বিভাগীয় শহরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বেসরকারি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

সার্বিক বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, পুলিশিংয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার যে সুযোগ রয়েছে, তা অন্য পেশায় নেই। এই সকল বিষয়ের কারণে পুলিশে করোনা সংক্রমণের হার একটু বেশি। আমাদের ঝুঁকি বেশি, আবার আমরা ঝুঁকি নিচ্ছিও। আমাদের সদস্যরা দেশ এবং মানুষকে ভালোবেশে কাজ থেকে পিছপা হচ্ছেন না। সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব রয়েছে বা সুরক্ষা সামগ্রী পেতে আমরা অপেক্ষা করছি, সে কারণে দায়িত্বে নামেননি এমনটি পুলিশ সদস্যরা কখনো করেননি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here