দ্রুত ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির শীর্ষ দেশের তালিকায় আবারো বাংলাদেশের নাম

0
386

 

জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার আয়বৈষম্যও বাড়ছে। এর ফলে শুধু ধনীদের সম্পদ বাড়ছে। আর এতে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবেচনায় শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় আবারো উঠে এসেছে বাংলাদেশ। চলতি মাসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্স প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির বছর দুয়েক আগের প্রকাশিত প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের ধনীদের দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছিল।

এ ডিকেড অব ওয়েলথ, এ রিভিউ অব দ্য পাস্ট টেন ইয়ার্স ইন ওয়েলথ অ্যান্ড এ লুক ফরোয়ার্ডস টু দ্য ডিকেড টু কাম’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবচেয়ে দ্রুতগতিতে সম্পদ বাড়ছে এমন বাজারগুলো এশিয়ার। যেখানে রয়েছে ছোট-মাঝারি অর্থনীতির মিশ্রণ। সম্পদ দ্রুত বাড়ছে এমন শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে এশিয়ার ছয়টি। আঞ্চলিক সরবরাহ চেইন নিবিড়তা ও বাড়তে থাকা তরুণ কর্মশক্তির সহায়তা নিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারায় র্যাংকিংয়ের শীর্ষে রয়েছে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ।

 

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, গত এক দশক শুধু চীনেরই অব্যাহত সম্প্রসারণ নয়, বরং এর মধ্যে রয়েছে অঞ্চলটির অন্যান্য অর্থনীতিরও উন্নয়ন। অর্থনীতিগুলো দ্রুত নগরায়ণসহ কম উৎপাদনশীল কৃষি থেকে শিল্প ও সেবা খাতের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম দুই দেশেই ২০১০ সালে তুলনামূলক কম সম্পদশালী ব্যক্তি ছিল। যার আংশিক প্রতিফলন হলো দেশগুলোর সম্পদশালী জনগোষ্ঠীর শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি। বিশ্বের সব দেশের তুলনায় বহিরাগত সম্পদ সত্ত্বেও সম্পদের দ্রুত বৃদ্ধি হওয়া শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে রয়েছে পরিপক্ব যুক্তরাষ্ট্র।

 

প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দ্রুত সম্পদশালী হওয়া বাজারগুলোতে ৫০ লাখ ডলারেরও বেশি সম্পদ এমন জনগোষ্ঠীর বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ভিয়েতনামে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। তালিকার তৃতীয় অবস্থানে চীনের প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে থাকা কেনিয়ার ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। পঞ্চম অবস্থানে ফিলিপাইনসের ক্ষেত্রে সম্পদশালীদের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৯ শতাংশ।

 

থাইল্যান্ডে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, দেশটির অবস্থান ষষ্ঠ। সপ্তম অবস্থানে থাকা নিউজিল্যান্ডে বার্ষিক গড় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। পরিপক্ব বাজার যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে অষ্টম অবস্থানে, দেশটিতে ৫০ লাখ ডলারেরও বেশি সম্পদশালীদের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এদিকে নবম অবস্থানের পাকিস্তানে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। দশম অবস্থানে রয়েছে আয়ারল্যান্ড, দেশটির সম্পদশালীরা বার্ষিক ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়ছে।

 

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদেরসহ গোটা এশিয়ায়ই একদিক থেকে বিষয়টি গর্বের। আরেক দিক থেকে বিষয়টি উদ্বেগের। এরই মধ্যে যুক্ত হয়ে না থাকলেও গর্ব এজন্য যে আমাদের কিছু মানুষ বিলিয়নেয়ার লীগে যুক্ত হবেন। খুব দূর ভবিষ্যৎ নয় যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছে। ভারতও অনুসরণ করবে। আর আমরাও ছোট আকারে অনুসরণ করব। বিষয়টির ইতিবাচক এ দিকটি গর্বের। অন্য দিক হলো আয়বণ্টন, যা প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। গত এক দশকে আয়বণ্টন ছিল খুবই খারাপ, যা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের। এ সমস্যাটি সবসময়ই ছিল।

 

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ওয়েলথ অ্যাকুমুলেশন র্যাপিডলি হচ্ছে। যেটা হচ্ছে সেখানে একশ্রেণীর লোক রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে এটাকে অনেক বড় করে ফেলছে। সমাজের খেলায় কোনো ন্যায্যতা নেই। সরকারের করনীতিরও ব্যর্থতা এটা। করনীতিতে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যারা রাজস্ব দিচ্ছে তাদের মধ্যে ধনী ব্যক্তিদের নাম নেই। বাংলাদেশের বিলিয়নেয়াররা সর্বোচ্চ করদাতা নয়। সমাজের সমতা নিশ্চিত করার ধারায় আসতে অন্যতম উপকরণ হলো করনীতি। উন্নত দেশগুলোয় এটাই করা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে কিছু হচ্ছে না।

 

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত ১০ বছরে যেটা হয়েছে ২০০০ সালের দিকে আমাদের নিচে থাকা শীর্ষ ৫ শতাংশের অংশ ১ শতাংশের ওপরে ছিল। সেটা ২০১০-এ নেমে দশমিক ৯ শতাংশের মতো এসেছে। ইদানীং সেটা আরো কমে শূন্য দশমিক ২ থেকে শূন্য দশমিক ৩-এ চলে গেছে। এটা গুরুতর উদ্বেগ। এখন প্রকৃত অর্থেই চিত্রটি খারাপ। কারণ তাদের অংশটা এক-চতুর্থাংশ হয়ে গেছে। এক দশক আগে ১ শতাংশের কম থাকলেও এখন তারও চার ভাগের এক ভাগ হয়ে গেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

 

দেশে গত কয়েক বছরে জিডিপির উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবেই। একই সঙ্গে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আয়ের বৈষম্যও বেড়েছে। আর এর ফলে সম্পদ বেড়েছে শুধু ধনীদেরই। গত পাঁচ বছরে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।

‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ধনকুবেরদের সামগ্রিক সম্পদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর ধনীদের সম্পদের প্রবৃদ্ধির এ হারের সুবাদে ওয়েলএক্সের তৈরি তালিকায়ও শীর্ষ দশের প্রথম স্থানটি বাংলাদেশের দখলেই ছিল। তবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্পদশালী ধনীদের সিংহভাগই চীনের। সম্পদের বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ৩০ শহরের মধ্যে চীনেরই রয়েছে ২৬টি। পাশাপাশি ভারত ও হংকংয়েও রয়েছে এমন সম্পদশালীদের উপস্থিতি। এর বাইরে যেসব দেশ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ হলো ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈষম্যের যে প্রবণতার কথা আমরা বলছি, যেখানে বৈষম্য প্রচণ্ডভাবে বাড়ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির সুফল একটা ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে জমছে। গবেষণায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

 

এ চিত্র উদ্বেগের কারণ উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দারিদ্র্য কমা সত্ত্বেও আয়ের বৈষম্য বাড়ছে, কেন্দ্রীকরণ বাড়ছে, সম্পদের বৈষম্য বাড়ছে। ভোগের যে বৈষম্য তার থেকে বেশি আয়ের বৈষম্য। আর এর চেয়েও বেশি সম্পদের বৈষম্য। সরকারি তথ্য-উপাত্তেই এ প্রবণতা দেখা যায়। এখন বৈশ্বিকভাবে যে চিত্র উঠে এসেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাজস্বনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, মুদ্রানীতি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে আমাদের আরো নজর দেয়া উচিত বলে এ গবেষণার তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সেখানে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া বাংলাদেশী ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আজিজ খান। প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস তাদের আগস্ট সংখ্যায় সিঙ্গাপুরের ৫০ শীর্ষ ধনীর যে তালিকা প্রকাশ করেছে মুহাম্মদ আজিজ খানের অবস্থান সেখানে ৩৪তম। বাংলাদেশী সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যানের মোট সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৯১ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি।

 

সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর র্যাংকিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের শেয়ারহোল্ডিংয়ের পাশাপাশি পরিবার, স্টক এক্সচেঞ্জ, বিশ্লেষক ও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া আর্থিক উপাত্ত ব্যবহার করেছে ফোর্বস। পারিবারিক সম্পদও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তালিকায়।

 

গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিতে দুটি ধাপে তথ্য বিশ্লেষণ করে ওয়েলথএক্স ইনস্টিটিউট। প্রথম ধাপে ইকোনমেট্রিক কৌশল ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পুুঁজিবাজারের আকার, জিডিপি, করহার, আয় ও সঞ্চয়ের তথ্য সংগ্রহ করে তারা। এজন্য তথ্যের উৎস হিসেবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, ওইসিডি এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পরিসংখ্যান সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

আর দ্বিতীয় ধাপে জনপ্রতি সম্পদের পরিমাণ হিসাব করা হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পদের বণ্টনসংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশে মানুষের আয়বণ্টনের হিসাব বিবেচনায় নেয়া হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কাছে থাকা বিশ্বব্যাপী অত্যধিক সম্পদশালী ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করা হয়। এতে আর্থিক স্থিতি, কর্মজীবন, ঘনিষ্ঠ সহযোগী, পারিবারিক তথ্য, শিক্ষাজীবন, আগ্রহ ও শখসহ সম্পদশালীদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি অর্জিত সম্পদের বিনিয়োগ ও ব্যয়ের প্রবণতার তথ্যও বিবেচনায় নেয়া হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্পদের প্রকৃত ও গ্রহণযোগ্য চিত্র তুলে ধরা হয়।

 

ওয়েলথএক্সের নিজস্ব এ মডেলে নমিনাল জিডিপি বিবেচনায় বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর জনগোষ্ঠী, সম্পদ ও বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের পরিমাণ হিসাব করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here