দেশের প্রায় ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বন্ধ

0
442
Graphic Source: American Society of Microbiology

 

দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনভাতা বন্ধ। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত তাদের মার্চের বেতনভাতা দেয়নি। কিছু প্রতিষ্ঠান আংশিক দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কষ্টে দিন কাটছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের।

জানা যায়, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা যথাযথভাবে পরিশাধের ব্যাপারে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর চাপ আছে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধের তাগিদ আছে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তা তেমন একটা শুনছে না।

 

এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতার সংস্থান হয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিষ্ঠানের ভবনের ভাড়া, বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের বিল পরিশোধসহ অন্যান্য খরচও তারা এই অর্থে পরিশোধ করেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় বন্ধ আছে। এই দুর্যোগের মধ্যে ফি আদায়ের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে ঢাকা বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট রেগুলেটরি সংস্থাগুলো। এসব কারণে তারা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে পারছেন না। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছে। এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পায়নি বলে জানা গেছে।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা চেয়ে আবেদন করেছে বলে আমরা জেনেছি। তবে আবেদন রোববার পর্যন্ত আমাদের কাছে আসেনি। তাছাড়া বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট। কোনো আর্থিক ব্যাপারে আবেদন-নিবেদন পেলে আমরা তা বিবেচনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে থাকি।

 

করোনাভাইরাসের কারণে ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তেমন সমস্যা নেই সরকারি ও এমপিওভুক্তগুলোর। কারণ ওইসব প্রতিষ্ঠানের বেতনভাতা প্রতিমাসে দিয়ে যাচ্ছে সরকার। এমনকি কেউ কেউ উৎসব ভাতাও পাওয়ার পথে। তবে যত সমস্যা নিজস্ব আয়ে চলা বেসরকারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোয়। সাধারণ ছুটির আগে মার্চ মাসের টিউশন ফি নিতে পারেনি বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে সেখানে চলছে অর্থসংকট। এর ধকল সইতে হচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারীদের।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ৫৫ হাজার বেসরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্তমানে সংকটে আছে। এগুলোর মধ্যে ৪০ হাজারই কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল। এছাড়া আছে বিভিন্নরকম আধা-এমপিও, বেসরকারি ও প্রাইভেট স্কুল ৭ হাজার, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পৌনে ১০ হাজার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৯৬টি। কেজি স্কুলগুলোয় ৬ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। কারিগরি প্রতিষ্ঠানে জনবল আছে প্রায় আড়াই লাখ। বেসরকারি ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আছেন আরও অন্তত ৯০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। আর ৯৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ২৯ হাজার। এছাড়া শতাধিক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে আরও কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। সবমিলে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতনভাতা নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে সংকট।

 

এর মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার কেজি স্কুলের পক্ষ থেকে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখান থেকে তারা এসব স্কুলের জন্য ৫শ’ কোটি টাকা প্রণোদনা চেয়েছে। এতে বলা হয়, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সবই ভাড়া বাড়িতে চলে। ওই ভাড়া এবং শিক্ষকদের বেতনের সংস্থান হয় টিউশন ফি থেকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা দুর্যোগে প্রণোদনা চাচ্ছেন, যা আগে কখনও চাননি। আধা এমপিও, বেসরকারি ও প্রাইভেট ৯ হাজার স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অবশ্য এখনও প্রণোদনা চাওয়া হয়নি। মাইলস্টোন, ক্যামব্রিয়ান, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো প্রাইভেট ও আধা এমপিও এবং গ্রামগঞ্জে চলা বেসরকারি হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ঠিকমতো বেতনভাতা পাচ্ছেন না।

 

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোও প্রণোদনার দাবি তুলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন টেকনিক্যাল এডুকেশন কনসোর্টিয়াম অব বাংলাদেশ (টেকবিডি) ৩৯০ কোটি টাকার প্রণোদনা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছে। এই সংগঠনের সভাপতি প্রকৌশলী আবদুল আজিজ বলেন, প্রণোদনার অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি চাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানের নামে প্রয়োজনে সরাসরি শিক্ষক-কর্মচারীদের হিসাবে পাঠানো যেতে পারে। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে, তখন আমরা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সরকারের দেয়া শর্ত মেনে তা পরিশোধ করব। তবু আমরা চাই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা সচল থাকুক।

 

দেশের বর্তমানে সচল আছে ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে বড় পাঁচ-ছয়টি নিয়মিত বেতনভাতা দিচ্ছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বাকি ৯০টির শিক্ষক-কর্মচারীরাই আছেন সংকটে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মচারীকে এখন পর্যন্ত এপ্রিলের বেতনভাতা দেয়া হয়নি। বেশকিছু মার্চে আংশিক বেতনভাতা দিয়েছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা বলছেন, সাধারণত পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীরা টাকা দেয়। কিন্তু ক্লাস ৭০ ভাগ শেষ হওয়ার পর ছুটি হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা অর্থ আদায় করতে পারেননি। আবার আগের অর্থও সঞ্চিত নেই। কেননা, সরকারের পক্ষ থেকে চাপ থাকায় অনেকেই সঞ্চিত অর্থ ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করে ফেলেছেন। অন্যদিকে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নিলেও মাঝারি ও ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি পরিশোধ না করার ঝোঁক বেশি। তবে বেতনভাতা চালিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে।

 

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির পরিচালক ড. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের স্টাডি হচ্ছে, রাজধানীতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ২ হাজারের উপরে এবং মফস্বলে ৮শ’ থেকে এক হাজার, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে সচ্ছল। তাদের শিক্ষক-জনবলের বেতনভাতা দেয়ার ব্যাপারে কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়।’ তিনি আরও বলেন, বাড়ি ভাড়া বা ব্যাংক সুদের ইস্যুটি ভিন্ন। কিন্তু সাময়িক আয় বন্ধের ইস্যুকে সামনে এনে এর প্রভাব বেতনের ওপর পড়ে থাকলে সেটা দুঃখজনক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here