ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের সোহাগ অনলাইন প্ল্যাটফরম ই-ভ্যালির মাধ্যমে একটি অফিশিয়াল ওয়ান প্লাস ৭ প্রো (১২/২৫৬) মোবাইল ফোনের অর্ডার দিয়েছিলেন। দামি এই হ্যান্ডসেট তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা। সেভাবে তিনি বিল পরিশোধ করেন।
দুই মাস পর গত ৬ মে তাকে ফোনে জানানো হয়, নরসিংদী থেকে তাকে সেটটা নিতে হবে। বাধ্য হয়েই একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে নরসিংদী যান তিনি।
সেখান থেকে তাকে ভেলানগরে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে হ্যান্ডসেটটি নিয়ে খুলে দেখেন তাকে একটি আনঅফিশিয়াল হ্যান্ডসেট (৮/২৫৬) দেওয়া হয়েছে। এটা চাইনিজ ভার্সন।
অর্ডার করা সেটের তুলনায় এটার দাম অর্ধেক। ঘটনার পুরো বিবরণ দিয়ে ই-ক্যাবে অভিযোগ করেছেন সোহাগ। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি।
এমন অসংখ্য অভিযোগ অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। কোথাও অভিযোগ করে প্রতিকার মিলছে না। করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। খুব প্রয়োজনীয় হলে অনলাইনেই কেনাকাটা সারছেন। আর এই সুযোগে হাজার হাজার ভুঁইফোঁড় অনলাইন প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রিম টাকা নেওয়ার পর তাদের ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ করে দিচ্ছে। প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগ করার জায়গা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইক্যাবের সভাপতি শমী কায়সার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এমন অসংখ্য অভিযোগ আমাদের কাছেও আসছে। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের যারা সদস্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের ১ হাজার ১০০ মেম্বারের বাইরেও হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সম্প্রতি আমরা বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে কেউ অনলাইনে ব্যবসা করতে চাইলে তাকে আমাদের অ্যাসোসিয়েশন বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হবে। আর আমাদের সদস্যদের বাইরে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে, সেগুলো আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব। তারা ঐ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক (ঢাকা জেলার প্রধান) আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট আছে। ফেসবুক পেজও আছে। প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা স্ক্রিনশটসহ পেজের মধ্যে লিখে অভিযোগ করতে পারেন। তাদের সব অভিযোগই আমরা আমলে নিয়ে রাখছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শুনানির মাধ্যমে অভিযোগগুলোর সুরাহা করা হবে। এখন তো বন্ধ, যে কারণে কিছু করা যাচ্ছে না।’
অনেকে অনলাইনে কেনাকাটায় কিছু পণ্য হয়তো পাচ্ছেন, কিন্তু তা মানের দিক দিয়ে খুবই খারাপ। অনলাইনে যেটি দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে সেগুলো মিলছে না। অনলাইন প্ল্যাটফরমের প্রতিষ্ঠানগুলো ই-ক্যাবে নিবন্ধিত। ই-ক্যাবের মহাসচিব আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, খুব শিগিগরই একটি অনলাইন অভিযোগকেন্দ্র আমরা খুলছি। তিনি অনলাইনে কেনাকাটায় গ্রাহকদের আরো সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এখন এই সময়ে অনেক সুবিধাভোগী লোকজন এটার সুবিধা নিতে চাইছে। নতুন করে কোম্পানি তৈরি করছে, এটা একটা বড়ো সমস্যা। এ জন্য ভোক্তা অধিকারের সংরক্ষণ অধিদপ্তরকেও এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমান অবস্থায় সাধারণ মানুষের কেনাকাটার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে অনলাইন মার্কেটপ্লেস। গ্রাহক ধরতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয় অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো। মাস্ক, স্যানিটাইজার, চুল কাটার ট্রিমার কিংবা পোশাক—সব ধরনের পণ্য কেনাকাটায় দিচ্ছে লোভনীয় অফার। ঘরে বসে প্রয়োজনীয় পণ্যের অর্ডার দিচ্ছেন গ্রাহকেরা। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই আছে। তবে বিপত্তি শুরু হয় মূল্য পরিশোধের পর। শেওড়াপাড়ার রফিকুল ইসলাম নামে এক চাকরিজীবী জানান, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বাচ্চাদের জন্য কিছু কাপড় অর্ডার দিয়েছেন। এরপর থেকে ফোন দিলে ঐ প্রতিষ্ঠানের হটলাইন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, ‘আমাদের কাছেও অসংখ্য অভিযোগ আসছে। আমরা তাদের ভোক্তা অধিকারে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। ফোনের মাধ্যমে কিছু সমস্যার সমাধানেরও চেষ্টা করছি। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে অনলাইনে এই প্রতারণা অনেক গুণ বেড়ে গেছে।’
কয়েক দিন আগে মৌচাক মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত টিপু সুলতান নামে একজনকে গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে অর্ধশতাধিক ‘ভাইরাস শাট আউট’ নামের কার্ড জব্দ করা হয়। ঐ কার্ড গলায় ঝুলিয়ে রাখলে করোনা রোগের ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এমনটাই দাবি করেছিলেন তিনি। পরে তাকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারণা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এখন শুধু ভোক্তা অধিকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, র্যাব-পুলিশকেও ব্যবস্থা নিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে অভিযান চালানো ছাড়া এই প্রতারণা বন্ধ করা যাবে না।’